বাংলাদেশি সাদাত রহমানের শিশু শান্তি পুরস্কার জয়

কালের কলম
6 Min Read

১৭ বছর বয়সী বাংলাদেশি টিনেজার সাদাত রহমান পেয়েছে ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেনস পিস প্রাইজ। একে শিশুদের জন্য আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার হিসেবে দেখা হয়। শুক্রবার নেদারল্যান্ডসে ছোট্ট পরিসরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সাদাতকে পুরস্কৃত করা হয়।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে অনুষ্ঠানটি অনলাইনে সম্প্রচার করা হয়। ২০১৩ সালে এই পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে সাদাতের হাতে পুরস্কার তুলে দেন এবং তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। পুরষ্কারের মূল্যমান এক লাখ ইউরো, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় এক কোটি ৪৫ লাখ টাকার কাছাকাছি। এই অর্থ দিয়ে নিজের কাজের পরিধি আরো বিস্তৃত করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে সাদাত। তার সঙ্গে চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পাওয়া অন্য দুজন হলো মেক্সিকোর ইভান্না ওরতেজা সেরেট ও আয়ারল্যান্ডের সিয়েনা ক্যাস্টেলন।

ওই পুরস্কারের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু গত ২৯ অক্টোবর ওই তিন প্রতিযোগীর নাম ঘোষণা করেন।

সাইবার বুলিং বা সাইবার অপরাধ থেকে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য একটি অ্যাপ তৈরি করেছে সাদাত। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘সাইবার টিনস’। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সী একটি কন্যাশিশুর আত্মহত্যার খবর শুনে সাদাত রহমান তার অ্যাপ তৈরি করে। তার এ প্রচেষ্টার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই। এ খবর দিয়েছে অনলাইন এএফপি এবং বিবিসি। এতে আরো বলা হয়, বর্তমানে সাদাতের অ্যাপ ব্যবহার করছে তার স্থানীয় জেলার প্রায় ১৮০০ টিনেজ। সাদাতের বাড়ি বাংলাদেশের নড়াইলে। মালালা ইউসুফজাই তাকে একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মালালা অনলাইনে দেয়া এক বক্তব্যে বলেছেন, সারাবিশ্বে সাইবারবুলিং বন্ধ করতে তরুণ, টিনেজ বয়সীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে সাদাত। ‘সাদাত ইন এ ট্রু চেঞ্জমেকার’।

উল্লেখ্য ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেনস পিস প্রাইজ একটি বার্ষিক পুরষ্কার। বিশ্বে তরুণ বা টিনেজ বয়সী, যারা শিশু অধিকার সুরক্ষার উদ্দেশে কাজ করে, তাদের কাজকে স্বীকৃতি দিতে এ পুরষ্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। এর আগে এ পুরষ্কার যারা পেয়েছেন তার মধ্যে রয়েছেন সুইডেনের জলবায়ু বিষয়ক অধিকারকর্মী গ্রেটা থানবার্গ। এ অবস্থায় সাদাত রহমানের অ্যাপ ‘সাইবার টিনস’ কিশোর, তরুণ বংসীদের জন্য সহায়ক হয়ে এসেছে। তারা এই অ্যাপ ব্যবহার করে স্বেচ্ছাসেবকদের একটি নেটাওয়ার্ককে ঘটনা জানাতে পারে। পরে ওইসব স্বেচ্ছাসেবক বিষয়টি পুলিশ বা স্থানীয় সমাজকর্মীদের কাছে নিয়ে তাদের সহায়তা চান। এই অ্যাপটি চালু করার পর কমপক্ষে ৩০০ তরুণ বা টিনেজার অনলাইন ক্রাইমের হাত থেকে সুরক্ষা পেয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে আটজনকে। এর মধ্যে শিশুদের অনলাইনে হয়রান করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েকজনকে।
পুরস্কারের টাকা দিয়ে সাদাত রহমান বাংলাদেশের সব স্থানে ব্যবহার করা যায় এমন অ্যাপ তৈরি করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। এটাকে সারাবিশ্বের মডেল হিসেবে দাঁড় করাতে চায় সাদাত। পুরস্কার গ্রহণ করে সাদাত রহমান বলেছেন, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কিশোর বা তরুণদের অর্ধেকই সাইবার পুলিংয়ের শিকার। আতঙ্ক এবং জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে আগে এর অনেক অপরাধের বিষয়ে রিপোর্টি করতে বিরত রেখেছিল তাদের।

২০০৫ সালে রোমে অনুষ্ঠিত নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের এক শীর্ষ সম্মেলন থেকে এই পুরস্কার চালু করে ‘কিডস-রাইটস’ নামের একটি সংগঠন। শিশুদের অধিকার উন্নয়ন ও নিরাপত্তায় অসাধারণ অবদানের জন্য প্রতিবছর আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা ওই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। গত বছর সুইডেনের শিশু পরিবেশকর্মী গ্রেটা থানবার্গ ও ক্যামেরুনের ডিভিনা মালম যৌথভাবে মর্যাদাপূর্ণ ওই পুরস্কার পান। ১৭ বছর বয়সী সাদাত নড়াইল আবদুল হাই সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। সাদাত রহমান ও তার দল সাইবার বুলিং ও সাইবার ক্রাইম থেকে শিশু-কিশোরদের রক্ষায় নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সাদাত সম্পর্কে কিডস রাইটসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সাদাত একজন ‘তরুণ চেঞ্জমেকার’ ও সমাজসংস্কারক। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে এক কিশোরীর (১৫) আত্মহত্যার পর কাজে নামে সাদাত।

সে তার বন্ধুদের সহায়তায় ‘নড়াইল ভলেন্টিয়ারস’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন শুরু করে। এই সংগঠন বেসরকারি সংস্থা একশনএইডের ‘ইয়ুথ ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ-২০১৯’-এ বিজয়ী হয়ে তহবিল পায়। এই তহবিলের মাধ্যমে তারা ‘সাইবার টিনস’ মোবাইল অ্যাপ তৈরি করে। এই অ্যাপের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীরা জানতে পারে কীভাবে ইন্টারনেট দুনিয়ায় সুরক্ষিত থাকতে পারে। এই অ্যাপের মাধ্যমে ৬০টির বেশি অভিযোগের মীমাংসা হয়েছে এবং ৮ জন সাইবার অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হয়েছে। বর্তমানে সাদাত ‘সেফ ইন্টারনেট, সেফ টিনএজার’ নামের একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সে এবং তার বন্ধুরা ইন্টারনেট নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে স্কুলে স্কুলে সেমিনার-কর্মশালা করছে। তারা প্রতিটি স্কুলে ‘ডিজিটাল স্বাক্ষরতা ক্লাব’ প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে।

সাদাত রহমান জানায়, সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে পিরোজপুরের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা তাকে নাড়া দেয়। দেশে এ ধরনের আরও ঘটনা ঘটছে। এক হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৪৯ শতাংশ কিশোর-কিশোরী এ রকম সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়। কিন্তু নিজেদের সমস্যা কাউকে বলতে পারে না তারা। পুলিশ তো দূরের কথা, অনেকেই নিজের মা-বাবাকেও এ ব্যাপারে কিছু জানায় না। শেষ পর্যন্ত অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

সাদাত বলছে, এ ধরনের উপলব্ধি থেকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া শিশু-কিশোরদের সাহায্য করতে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সাইবার টিনসের যাত্রা শুরু গত বছর অক্টোবর মাসে। এই অ্যাপের মাধ্যমে ভুক্তভোগী কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যোগাযোগ সৃষ্টি করা হয়। প্রথমত, ভুক্তভোগীকে মানসিক সাপোর্ট দেওয়া হয়। অভিযুক্তকেও নিবৃত্ত করার চেষ্টা করা হয়। তবে বিষয়টি অপরাধ পর্যায়ে পৌঁছালে পুলিশ বিভাগকে জানানো হয়। নড়াইলের জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিমউদ্দিনের সহযোগিতায় এই কার্যক্রম আরও গতিশীল হয়েছে।

Share This Article