উন্নয়ন সংবাদ | কালের কলম :
সম্ভাবনা আজ বাস্তবতা। সবার চোখে দৃশ্যমান এই সেতু নির্মাণের অগ্রগতি। বসানো হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সবশেষ স্প্যান। জোড়া লেগেগেলো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের স্বপ্নের। সবগুলো স্প্যান স্থাপনের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান পুরো কাঠামো। বাকি থাকলো শুধু রোড ও রেল লাইন বসানোর কাজ।
গতরাতেই সবশেষ স্প্যানটি মাওয়ার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে ভাসমান ক্রেনে ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের কাছে নেয়া হয়। শেষ স্প্যানটি বসানোর কাজ হওয়ার মধ্য দিয়ে ৬ কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের সেতুর সবটাই দৃশ্যমান হলো।
কর্তৃপক্ষ জানায়, পদ্মার দুই প্রান্ত- মাওয়া ও জাজিরা এক বিন্দুতে মিলেছে। ৩ বছরের কাছাকাছি সময়ে সবগুলো অর্থাৎ ৪১টি স্প্যান স্থাপনের কাজ শেষ।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয় প্রথম স্প্যান। এই সুপারস্ট্রাকচারের ভেতর দিয়েই চলবে রেল আর উপর দিয়ে থাকবে সড়ক। সব জল্পনা-কল্পনা আর অনিশ্চয়তার দূরে ঠেলে পদ্মা সেতু এখন বাস্তবতা। এতে শুধু পদ্মা সেতুর দু’পাড়ের মানুষই নয়, উচ্ছ্বসিত সারাদেশের মানুষের।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের জুন মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। পরবর্তীতে জুলাইতেই নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। নানান শঙ্কা, উৎকণ্ঠা আর ঘটনা পেরিয়ে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ।
মূল সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। কাজ পায় চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। তাদের সঙ্গে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকার চুক্তি হয়। চার বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কাজ শুরুর পরের বছরই মাওয়ায় স্থাপিত নির্মাণ মাঠের বেচিং প্ল্যান্টসহ একাংশ নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায়।
২০১৭ সালে প্রতিটি খুঁটির নিচে মাটি পরীক্ষায় ২২টি খুঁটির নিচে নরম মাটি পাওয়া যায়। তখন নকশা সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফেরিঘাট স্থানান্তরেও সময়ক্ষেপণ হয়। শুরুতে প্রতিটি খুঁটির নিচে ছয়টি করে পাইল (মাটির গভীরে স্টিলের ভিত্তি বসানো) বসানোর পরিকল্পনা ছিল।
যুক্তরাজ্যের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নকশা সংশোধন করে একটি করে পাইল বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। এ জন্য খুঁটি নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হতে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত লেগে যায়। সব মিলিয়ে এই কাজে প্রায় এক বছর বাড়তি লাগে। এ জন্য মাঝে কাজে কিছুটা গতি হারায়। ঠিকাদারকে ২ বছর ৮ মাস বাড়তি সময় দেওয়া হয়। নভেম্বর পর্যন্ত মূল সেতুর ৯১ শতাংশ কাজ শেষ হয়।
নদীশাসনের কাজও শুরু হয় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন। তাদের সঙ্গে চুক্তি ৮ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল চার বছরে। ২০১৭ সালের দিকে স্রোতের কারণে মাওয়ায় নদীর তলদেশে গভীর খাদ তৈরি হয়। এ ছাড়া মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে বিভিন্ন সময় ভাঙনও দেখা দেয়। ফলে নদীশাসনের কাজে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে। এখন আড়াই বছর সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নভেম্বর পর্যন্ত নদীশাসনের কাজ শেষ হয়েছে ৭৬ শতাংশ। দুই পারে সংযোগ সড়ক, টোল প্লাজা ও অবকাঠামো নির্মাণের কাজ আগেই শেষ হয়ে গেছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনও সম্পন্ন হয়েছে। সব মিলিয়ে নভেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৮২ দশমিক ৫০ শতাংশ।
২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিস্তারিত সমীক্ষার পর ২০০৪ সালে মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয় জাপানের দাতা সংস্থা জাইকা। ২০০৭ সালে একনেকে পাস হওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।
এরপর প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন না করে ২০১৮ সালের জুনে আবারও ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে আরেক দফা প্রস্তাব সংশোধন করতে হবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে জিডিপি বৃদ্ধি পাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু অর্থনীতিতে যেমন প্রভাব ফেলবে, সহজ হবে মানুষের চলাচলও।