আহমাদুল কবির, মালয়েশিয়া:
মালয়েশিয়ার উন্নয়ন অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০১৬ সালের মার্চ থেকে একটি গবেষণা শুরু করে বিশ্বব্যাংক। ২০২০ সালের এপ্রিলে ‘হু ইজ কিপিং স্কোর? এসটিমেটিং দ্য নাম্বার অব ফরেন ওয়ার্কার্স ইন মালয়েশিয়া’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়। সেখানে দেখানো হয়, মালয়েশিয়ার টেকসই অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রয়েছে বিদেশী শ্রমিকদের। দেশটির লেবার ফোর্স সার্ভের তথ্য ব্যবহার করে এতে বলা হয়, সেখানে প্রায় ২২ লাখ ৭০ হাজার বিদেশী কর্মী বিভিন্ন খাতে কর্মরত। সে হিসেবে দেশটিতে অবৈধভাবে কর্মরত প্রায় ১২ লাখ বিদেশী শ্রমিক।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, মালয়েশিয়ায় অবৈধ হয়ে পড়া বিদেশী কর্মীর ৪১ শতাংশই বাংলাদেশী, ৩০ শতাংশ ইন্দোনেশিয়ার, ১২ শতাংশ ভারতের, ফিলিপাইনের ৬ শতাংশ ও নেপালের ৫ শতাংশ, ২ শতাংশ করে পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার এর নাগরিক। এছাড়া শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ড থেকে প্রবেশ করা কর্মীরাও মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে অবস্থান করছেন।
অবৈধ হলেও মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে অবদান রাখায় এসব কর্মীদের বৈধ হওয়ার জন্য নব্বইয়ের দশক থেকেই বৈধ হবার সুযোগ দিচ্ছে , সাম্প্রতিককালের ৬পি, রি হায়ারিং, রিকেলাইব্রাসি এবং কোম্পানি পরিবর্তন করার সুযোগ দিয়েছে। এসব কর্মসূচির আওতায় বৈধ হবার সুযোগ পেয়েছে বিদেশি কর্মীরা। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের কর্মীদের অংশ সর্বাধিক। ফলে এটাই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের কর্মীরা বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করতে বেশি আগ্রহী। আবহাওয়া, খাবার , ধর্মীয় সাযুজ্য থাকায় বাংলাদেশীদের জন্য পছন্দের অন্যতম দেশ মালয়েশিয়া। শুধু কর্মী নয় দক্ষ, প্রফেসনাল ও শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশীরা অবস্থান করছে।
অবৈধ হবার কারণ হিসেবে বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণা মতে, বিভিন্ন দেশ থেক উল্লেখযোগ্য একটা অংশ সেখানে গিয়েছিলেন ট্যুরিস্ট ভিসায় এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজ দেশে না ফিরে তারা সেখানে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত হয়ে থেকে যাচ্ছেন। দেশটির আইন অনুযায়ী, আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকরা ট্যুরিস্ট ভিসায় গিয়ে মালয়েশিয়ায় ৩০ দিনের বেশি অবস্থান করতে পারবেন না। তবে আসিয়ানের সদস্য নয় এমন দেশগুলোর নাগরিকরাও অন অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা নিয়ে মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে অবস্থান করেছেন। এসব নাগরিকের বেশির ভাগ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার। এ কারণে মালয়েশিয়া সরকার ২০১৯ সালে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, চীন, নেপাল ও মিয়ানমারের নাগরিকদের অন অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৭ সালেই মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫০০ জন বিদেশী অন অ্যারাইভাল সুবিধা নিয়ে প্রবেশ করে এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সেখানে অবৈধভাবে অবস্থান করেছেন। একই সঙ্গে তারা কর্মসংস্থানের চেষ্টাও করেছেন। বৈধতা না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালায় দেশটির ইমিগ্রেশন ও পুলিশ। গত মাহাথির সরকারের সময় মালয়েশিয়ান নাগরিকদের অবৈধ বিদেশিদের সম্পর্কে তথ্য দিতে অনুরোধ করে এবং এখন অবধি বহাল আছে। ইদানিং বিশেষ টাস্কফোর্স করে ইমিগ্রেশন বিভাগের নেতৃত্বে বিদেশি কর্মী অধ্যুষিত এলাকা বা কারখানায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ বিদেশি সনাক্ত করা হচ্ছে। তবে বিদেশি নাগরিক বা কর্মীদের করোনা ভাইরাসের টিকা বিনামূল্যে প্রদান করছে মালয়েশিয়া সরকার।
এদিকে চলমান করোনাভাইরাসের সংক্রমণে অন্য দেশের মতো মালয়েশিয়ার অর্থনীতিও মারাত্মকভাবে ক্ষতির শিকার। ফলে স্থানীয় কর্মীদের কাজের পরিধি বাড়াতে প্রবাসী কর্মী কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির সরকার। এরকম হলে অবৈধভাবে যারা কাজ করছে তাদের সেই কাজ হারিয়ে বেকার হবার আশঙ্কা রয়েছে। তবে যারা বৈধভাবে নিয়োগকর্তার অধীনে আছে তাদের কাজের অবস্থা পূর্বের ন্যায় আছে এবং টার্ম শেষ হলে নিয়োগকর্তা আইন অনুযায়ী নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের পরিসংখ্যান বলছে, মালয়েশিয়া অবৈধদের অধিকাংশই অদক্ষ ও স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিক। এরা দেশটির নিম্নমানের যেসব পেশা রয়েছে সেসব পেশায় কাজ করেন। এ অদক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে বড় অংশ প্রতিবেশী দেশ ইন্দোনেশিয়া, নেপাল ও বাংলাদেশের। এ অনিয়মিত কর্মীদের মধ্যে অনেকেই দেশটির মধ্যে পলিয়ে থেকেই কাজ করে। এর মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি রয়েছে। মালয়েশিয়া সরকার এ অনিয়মিত শ্রমিকদের বৈধতা দিতে ‘জিরো ইরেগুলার মাইগ্রেশন বাই ২০২০’ পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন আইন অনুযায়ী অবৈধভাবে প্রবেশ, পাসপোর্ট না থাকা, ভিসা না থাকা, ভিসার অপব্যবহার করা এবং ওভার স্টে করা দন্ডনীয় অপরাধ এবং ফলে জেল, জরিমানা এবং বেত্রাঘাত শাস্তি শেষে ব্ল্যাক লিস্ট করে নিজ দেশে ফেরত প্রেরণ করে।
প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলছে, দীর্ঘ নিয়োগ প্রক্রিয়া ও অধিক অভিবাসন খরচ হওয়ায় প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে অবৈধ হওয়ার হার বাড়ছে। বিশ্বব্যাংক মালয়েশিয়াকে প্রস্তাব করেছে, প্রবাসী কর্মীদের জন্য অভিবাসন নীতি তৈরি করলে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে আরো এগিয়ে যেতে পারবে এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলো তাদের সহযোগিতায় আরো এগিয়ে আসবে। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে মালয়েশিয়া প্রতিনিয়ত উন্নত হলেও তাদের শ্রমবিষয়ক সুযোগ-সুবিধা অপরিবর্তিত রয়েছে। স্বল্পদক্ষ প্রবাসীদের ওপর তুলনামূলক কাজের চাপ বেশি থাকে। দেশটির উৎপাদন খাতে শ্রম উৎপাদনশীলতা কমেছে বলেও উল্লেখ করেছে।
সম্প্রতি মানব সম্পদ মন্ত্রণালয় ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা মালয়েশিয়ায় থাকা কর্মীদের মিথ্যা আশ্বাস, কাজের মিথ্যা তথ্য, অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ, বেতন, আবাসন, পাসপোর্ট আটকে রাখা , শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্ ২২ টি বিষয় যা মানব পাচার ও দাসত্বের শ্রমের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে তথ্য দিতে অনুরোধ করেছে এবং কিছু এনজিও এই কাজ করছে। অপর দিকে মানব সম্পদ মন্ত্রণালয় একই বিষয়ে বা কর্মীর যে কোন সমস্যার বিষয়ে অবহিত করার জন্য ওয়ার্কিং ফর ওয়ার্কার নামক অ্যাপ চালু করেছে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায় মালয়েশিয়ার অবস্থান টায়ার তিন এ অবনমন করায় শ্রম ইস্যুগুলো নিয়ে সরকার বেশ সোচ্চার হয়েছে, যার প্রতিফলন অচিরেই দেখা যাবে এবং কর্মীরা ভোগ করবে।