আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি ফুটবলার ডিয়েগো ম্যারাডোনা আর নেই। বেশ কয়েক দিনের অসুস্থতার পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গতকাল বুধবার মারা যান ফুটবলের জাদুকর। ৬০তম জন্মদিন উপলক্ষে গত ৩০ অক্টোবর ম্যারাডোনার সাক্ষাৎকার নিয়েছিল আর্জেন্টিনার সংবাদপত্র ‘ক্লারিন’। কে জানত, সেটিই হবে তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার। পড়ুন সে সাক্ষাৎকারটি-
প্রশ্ন: আপনার জীবনের সবচেয়ে ভালো এবং খারাপ ঘটনা কোনটি? কোনো আফসোস আছে?
ম্যারাডোনা: জীবন নিয়ে আমি খুব খুশি। ফুটবল আমাকে সব দিয়েছে। আশার চেয়ে বেশিই দিয়েছে। নেশায় আসক্ত না হলে হয়তো আমি আরও অনেক দিন খেলতে পারতাম। তবে ওসব দিন গত হয়েছে। আমি ভালো আছি। আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো, মা-বাবাকে এখন পাশে না পাওয়া। তোতার (ম্যারাডোনার মা) সঙ্গে যদি আর একটা দিন পেতাম! তবে আমি জানি স্বর্গে তিনি বেশ আনন্দেই আছেন আর আমাকে নিয়ে গর্ব করেন।
প্রশ্ন: নিজের জন্মদিনে আর্জেন্টিনার সব মানুষের জন্য যা চাইবেন…
ম্যারাডোনা: যত দ্রুত সম্ভব এই মহামারি কাটিয়ে আমার আর্জেন্টিনা এগিয়ে যাক। আমাদের দেশটা চমৎকার। দেশের মানুষের ভালো থাকাই আমার চাওয়া। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের প্রেসিডেন্ট এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাবেন। যখন দেখি শিশুদের পর্যাপ্ত খাবার নেই, আমার খুব দুঃখ হয়। খিদের জ্বালা আমি ভালো করেই জানি। দিনের পর দিন না খেয়ে থাকার কষ্ট আমি বুঝি। আমার দেশে এমনটা চলতে পারে না। আর্জেন্টিনার মানুষদের সুখী দেখা, সবাই কাজ করছে, ঠিকমতো খেতে পারছে-এটাই আমার চাওয়া।
প্রশ্ন: করোনা মহামারি আপনাকে ভালোভাবেই আঘাত করেছে। আপনার ভগ্নিপতি মারা গেলেন। বোন আক্রান্ত হয়েছেন। আপনাকেও সতর্কতার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। করোনাভাইরাসকে কি ভয় করে আপনার?
ম্যারাডোনা: আমাদের জন্য এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে! এমন কিছু কখনো দেখিনি আমি। তবে এ ক্ষেত্রে লাতিন আমেরিকা অন্যদের চেয়ে সফল। আশা করছি, শিগগিরই এ থেকে মুক্তি পাব আমরা। অনেকের দুঃসময় যাচ্ছে। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। অনেকের ঘরে পর্যাপ্ত খাবার নেই। তবে পুতিনের (রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন) ওপর বিশ্বাস আছে আমার। অল্প সময়ের ভেতর তাঁর দেশ ভ্যাকসিন তৈরি করে ফেলবে বলে আমার বিশ্বাস।
প্রশ্ন: কেউ যখন আপনার কাছে আসে, আপনাকে দেখে, আপনাকে ছোঁয়, আপনার কি মনে হয় তাঁদের চেহারায় পরিবর্তন আসে?
ম্যারাডোনা: মানুষের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। প্রত্যেক দিন তারা আমাকে অবাক করে দেয়। তাঁদের অবদান কখনো ভোলার মতো নয়। সত্যিই আশাতীত। দীর্ঘদিন আমি খেলার বাইরে। মানুষ কি আজও আমাকে ভালোবাসে? এখনো কি আগের মতোই মনে করে আমাকে? মাঝেমধ্যেই ভাবি। যেদিন আমি জিমনাসিয়ার (২০১৯ সাল থেকে আমৃত্যু আর্জেন্টাইন ক্লাবটির ম্যানেজার ছিলেন ম্যারাডোনা) মাঠে ঢুকলাম, বুঝলাম, মানুষের ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়নি।
প্রশ্ন: আর্জেন্টিনার যেকোনো ঘরানার খেলোয়াড়ের পক্ষে নীল-সাদার টান এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব কেন?
ম্যারাডোনা: ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই আমরা দেশ ছাড়ি। দীর্ঘদিন থাকি দেশের বাইরে। তবু দেশের কথা কখনো ভুলি না। আর তাই জাতীয় দল থেকে ডাকা হলে আমরা ফিরে আসি। সেটা সাঁতারের জন্য হলেও। দেশের টান অনুভব করি। নিজ দেশের পতাকার জন্য লড়ি। আর সেখানেই আমরা অন্যদের চেয়ে আলাদা।
প্রশ্ন: আর্জেন্টিনার ক্রীড়াজগতের কোন দিকটি আপনাকে আশা দেখায়?
ম্যারাডোনা: সবকিছুই। আমি সবকিছুই দেখি। কোনো আর্জেন্টাইন যেখানে যা-ই করুক, আমি অনুসরণ করি। আর্জেন্টিনার পতাকা যেখানেই তোলা হোক, আমি সব সময় অনুপ্রেরণা দিয়ে যাব। যেকোনো আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়ের চেহারা আমাকে আনন্দ দেয়। সেদিন নাদালের বিপক্ষে ডিয়েগো শোয়ার্টজম্যানকে হারতে দেখলাম, ওর চেয়ে আমিই বরং বেশি কষ্ট পেয়েছি।
প্রশ্ন: মেসি-বার্তোমেউ-বার্সেলোনার ঘটনাটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ম্যারাডোনা: এটার শেষটা যে খারাপ হবে, তা আমি জানতাম। ভেবেছিলাম লিও (লিওনেল মেসি) হয়তো ক্লাবটি ছেড়ে যাচ্ছে। আমার বেলাতেও এমনটা হয়েছিল। বার্সেলোনা কোনো সহজ ক্লাব নয়। সেখানে লিও দীর্ঘদিন ধরে আছে। যেমন আচরণ ওর প্রাপ্য, তেমনটা পাচ্ছে না। ক্লাবটিকে ও নিজের সবকিছু দিয়েছে। তালিকার শীর্ষে নিয়ে গেছে। একদিন তার কাছে মনে হলো, হাওয়া বদলের জন্য বাইরে বেরোনো উচিত। অথচ ওরা বাধা দিল। মুখের ওপর ‘না’ করে দেওয়া যায় না। একটা চুক্তি আছে। ক্লাবটা বড়। মানুষ তোমাকে ভালোবাসে।