কালের কলম ডিজিটাল:
স্টারলিংক বাংলাদেশে আসার ঘোষণা ইতোমধ্যে অনেকের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ও উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। মার্কিন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এলন মাস্কের স্পেসএক্সের পরিচালিত স্যাটেলাইট-ভিত্তিক এই ইন্টারনেট সেবা ইতোমধ্যে বিশ্বের বহু দেশে উচ্চগতির ইন্টারনেটের একটি কার্যকর বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশেও এর আগমন ডিজিটাল সংযুক্তি এবং প্রযুক্তিগত সমতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। তবে প্রযুক্তির সুবিধার পাশাপাশি কিছু সীমাবদ্ধতা ও রাজনৈতিক বাস্তবতাও রয়েছে, যা উপেক্ষা করা উচিত নয়।
স্টারলিংকের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি ফাইবার অপটিক ক্যাবল বা মোবাইল টাওয়ার ছাড়াই সরাসরি স্যাটেলাইট থেকে ব্যবহারকারীর ডিভাইসে ইন্টারনেট সরবরাহ করতে পারে। ফলে দেশের দুর্গম অঞ্চল, পাহাড়ি এলাকা, দ্বীপ ও সীমান্তবর্তী এলাকাতেও ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানো সম্ভব হবে, যেখানে বর্তমানে ইন্টারনেট কাঠামো নেই বা দুর্বল। গতি ও ল্যাটেন্সির দিক থেকেও স্টারলিংক উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত। সাধারণত ৫০ থেকে ২৫০ এমবিপিএস পর্যন্ত গতি এবং ২০ থেকে ৫০ মিলিসেকেন্ড ল্যাটেন্সি পাওয়া যায়, যা ভিডিও স্ট্রিমিং, অনলাইন মিটিং এবং গেমিংয়ের জন্য উপযোগী। সেটআপ প্রক্রিয়াও সহজ—মাত্র একটি স্যাটেলাইট ডিশ ও রাউটার থাকলেই যথেষ্ট।
তবে এই সুবিধার পেছনে রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ। প্রথমত, স্টারলিংকের খরচ বাংলাদেশের সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য অত্যন্ত বেশি। প্রাথমিক হার্ডওয়্যার সেটআপে খরচ হতে পারে ৪০০ থেকে ৬০০ মার্কিন ডলার এবং মাসিক সাবস্ক্রিপশন ফি ৫০ থেকে ১২০ ডলার পর্যন্ত, যা দেশের গ্রামীণ বা মধ্যবিত্ত জনগণের নাগালের বাইরে। পাশাপাশি, আবহাওয়াজনিত সমস্যাও একটি বড় বাধা—বৃষ্টি বা মেঘলা আকাশে সিগন্যাল দুর্বল হয়ে যেতে পারে, যার ফলে ব্যবহারকারীরা সমস্যায় পড়তে পারেন।
প্রযুক্তিগত ও আর্থিক চ্যালেঞ্জ ছাড়াও রয়েছে আইনগত ও রাজনৈতিক কিছু জটিলতা। স্টারলিংক বাংলাদেশে চালু করতে হলে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির অনুমোদন প্রয়োজন। সরকার চাইলে এই অনুমোদন না দিয়ে সেবাটিকে বৈধভাবে চালু হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে। এমনকি অনুমোদন দেওয়ার পরেও, তা বাতিল করে কিংবা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সেবাটিকে সীমিত করা সম্ভব। সরকার কাস্টমসের মাধ্যমে হার্ডওয়্যার আমদানিতে বাধা দিতে পারে অথবা এসব ডিভাইসকে ‘নন-কমপ্লায়েন্ট’ ঘোষণা করতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে—সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় কি স্টারলিংক বন্ধ করা সম্ভব?
সাধারণ মোবাইল বা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের মতো স্টারলিংক বন্ধ করা সহজ নয়, কারণ এটি স্যাটেলাইট থেকে সরাসরি সংযোগ দেয়। ফলে সরকার যদি সেবাটি অফিশিয়ালি নিষিদ্ধও করে, কেউ যদি গোপনে ডিভাইস আমদানি করে ব্যবহার করে, তাহলে তা রোধ করা কঠিন। যদিও সিগন্যাল ব্লকার বা জ্যামার ব্যবহার করে কিছু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, তবে তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও প্রযুক্তিগতভাবে জটিল, এবং সব জায়গায় কার্যকর না-ও হতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও এমন নজির আছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময় স্টারলিংক ব্যবহারে ইউক্রেন অনেক জায়গায় পুনরায় ইন্টারনেট সুবিধা চালু করতে পেরেছিল। আবার চীন, রাশিয়া ও ইরান স্টারলিংকের মতো সেবা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও তাদের সফলতা সীমিত।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: স্টারলিংক কি বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীন ইন্টারনেট হবে, না কি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি হাতিয়ার হয়ে উঠবে?
এই প্রশ্নের বাস্তব উদাহরণ ইউক্রেন যুদ্ধ। ২০২২ সালে রাশিয়ার আক্রমণে ইউক্রেনের অনেক এলাকায় মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক ধ্বংস হয়ে যায়। তখন ইউক্রেন স্টারলিংকের সহযোগিতা চায় এবং এলন মাস্ক দ্রুত সেবা চালু করেন। ফলে সেনারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে ড্রোন নিয়ন্ত্রণ, গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও যোগাযোগ চালাতে সক্ষম হয়।
তবে পরে একটি বিতর্ক তৈরি হয়। ইউক্রেন সেনাবাহিনী ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান নৌবাহিনীর ওপর স্টারলিংকের মাধ্যমে হামলা করতে চাইলে, এলন মাস্ক ঐ অঞ্চলে সিগন্যাল বন্ধ করে দেন এবং বলেন, “আমি শান্তি চাই, যুদ্ধ নয়।”
এছাড়াও, মিয়ানমারের সেনাশাসিত সরকার বিভিন্ন সময়ে জনগণের ইন্টারনেট ব্যবহার সীমিত করতে স্টারলিংকের মতো সেবা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশেও একই রকম পরিস্থিতি ঘটতে পারে। সরকার চাইলে স্টারলিংককে আইনি কাঠামোর মধ্যে রেখে লাইসেন্স বাতিল করতে পারে, ডিভাইস আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে কিংবা প্রযুক্তিগতভাবে স্যাটেলাইট সিগন্যাল ব্লক করতে পারে।
রেডিও সিগন্যাল ব্লকের জন্য সাধারণত রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামার ব্যবহৃত হয়। এ প্রযুক্তি স্যাটেলাইটের নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে হস্তক্ষেপ করে সিগন্যাল দুর্বল বা বন্ধ করে দেয়। তবে এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সীমিত কার্যকারিতার। দেশের সর্বত্র এই প্রযুক্তি কার্যকর করা কঠিন, বিশেষত গোপনে ব্যবহৃত ডিভাইসগুলোর ক্ষেত্রে।
আন্দোলনের সময়, সরকার আঞ্চলিকভাবে সিগন্যাল ব্লক করে ইন্টারনেট ব্যবহারে বিঘ্ন ঘটাতে পারে, তবে সেটি সাময়িক এবং স্থানভেদে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। আন্দোলনকারীরা যদি গোপনে স্টারলিংক ব্যবহার করে, তবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য কঠিন হবে।
এই দিক থেকে এটি যেমন সরকারের কাছে একটি শক্তিশালী টুল, তেমনি জনগণের স্বাধীনতাও সীমিত করার উপায় হয়ে উঠতে পারে।
বর্তমানে স্টারলিংক বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারীকে সেবা দিচ্ছে। যেখানে প্রচলিত ইন্টারনেট কাঠামো দুর্বল, সেখানে এটি বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। এর নিয়ন্ত্রণ যদি একটি ব্যক্তি বা কোম্পানির হাতে থাকে, তবে ভবিষ্যতে এটি একটি বৈশ্বিক ক্ষমতার উৎসে পরিণত হতে পারে।
ইউক্রেন যুদ্ধের ঘটনা প্রমাণ করে, একটি দেশের জাতীয় নিরাপত্তা, তথ্যপ্রবাহ এমনকি আন্দোলনের ভবিষ্যতও নির্ভর করতে পারে কোনো এক ব্যক্তির সিদ্ধান্তের ওপর। এই বাস্তবতা ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে, যেখানে এক ব্যক্তির হাতে থাকবে এক প্রকার “গ্লোবাল সুইচ”।
যদি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ স্টারলিংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাহলে এলন মাস্ক বা তাঁর কোম্পানি রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ, পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণ এবং তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে অনন্য ক্ষমতা লাভ করতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি প্রতিরোধে আন্তর্জাতিকভাবে নীতিমালা তৈরি জরুরি। না হলে, একদিন সত্যিই এলন মাস্কের হাতে এমন এক “অদৃশ্য রিমোট কন্ট্রোল” থাকবে, যার মাধ্যমে তিনি ইচ্ছেমতো কোনো দেশের ইন্টারনেট প্রবাহ চালু বা বন্ধ করে দিতে পারবেন।
যদিও এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নীতিমালা রয়েছে, তারপরও প্রতি দেশে ভিন্ন ভিন্ন আইন ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এই সেবার ভবিষ্যত নির্ধারণ করে। ভবিষ্যতে এই নীতিগুলো আরও কঠোর ও স্পষ্ট হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কারণ স্যাটেলাইট ইন্টারনেট এখন জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের বিষয় হয়ে উঠছে।
সবকিছু মিলিয়ে, স্টারলিংক বাংলাদেশের জন্য একদিকে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির দরজা খুলে দিতে পারে, অন্যদিকে রাজনৈতিক ও আইনগত দিক থেকে একটি ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রও তৈরি করতে পারে। এটি ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে ও দুর্যোগকালে সহায়ক হতে পারে, তবে এর মূল্য, নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ও রাজনৈতিক ব্যবহারের দিক বিবেচনায় সচেতনভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।
অবশেষে, জনগণ ও সরকারের যৌথ দায়িত্ব এবং সচেতনতাই নির্ধারণ করবে—স্টারলিংক বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হবে, না কি এক নতুন ধরনের প্রযুক্তিগত অভিশাপ।