পর্দার আড়ালের মকসুদ জামিল মিন্টু ও হুমায়ুন আহমেদ’র প্রিয় সংগীত পরিচালক

কালের কলম
5 Min Read
চিত্র: সঙ্গীত পরিচালক মকসুদ জামিল মিন্টু, ছবি: দি ডেইলি ষ্টার

বিনোদন ডেস্ক: 

ছবির মানুষটিকে হয়তো দেখে অনেকেই চিনতে পারছেন না কিন্তু নাম শুনলে সবাই ঠিকই চিনবেন। বুকে সর্বদা দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ ধারন করা যে কজন গুনী মানুষ আছে তাদের মধ্য অন্যতম একজন তিনি। যিনি সবসময় থেকেছেন প্রচারের বাহিরে। আলম খান, আলাউদ্দিন আলী, খন্দকার নুরুল আলম, সত্য সাহা, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, শেখ সাদী খান, আবু তাহের এর পর বাংলা গানে যাকে তাদের যোগ্য উত্তরসুরি মনে হয় তিনি এই ‘মকসুদ জামিল মিন্টু’। এবার নিশ্চয়ই অনেকেই ভাবছেন; নামটি কোথায় যেন বারবার দেখেছি, শুনেছি ভাবছেন তাই না? হ্যাঁ, মকসুদ জামিল মিন্টু নামটি নিয়মিত চোখে পড়তো ৯০ দশকে হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয় সব নাটকে। এরপর হুমায়ুন আহমেদের প্রায় সব সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি।

হুমায়ুন আহমেদের চন্দ্রকথা ছবিতে বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লাকে সুর ও সঙ্গীত প্র্যাক্টিস করাচ্ছেন সঙ্গীত পরিচালক মকসুদ জামিল মিন্টু, ছবি দি ডেইলি ষ্টার
চিত্র: হুমায়ুন আহমেদের চন্দ্রকথা ছবিতে বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লাকে সুর ও সঙ্গীত প্র্যাক্টিস করাচ্ছেন সঙ্গীত পরিচালক মকসুদ জামিল মিন্টু, ছবি: দি ডেইলি ষ্টার

একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহর সন্তান মকসুদ জামিল মিন্টু বাবার মতো সাংবাদিক না হয়ে সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৭৮ সালে বিটিভিতে গীটার বাদক হিসেবে নিয়মিত বাজাতে থাকেন। এরপর বিটিভিতে একজন কিবোর্ড বাদক হিসেবেও বহুদিন বাজিয়েছেন নিয়মিত। বাজাতে পারেন বেহালাও। ১৯৮২ সালে তিনি সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সাথে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। তিনি প্রথম “মেঘ বিজলী বাদল” চলচ্চিত্রের জন্য গীটার বাজান। একই সালে এন্ড্রো কিশোরের জন্য একটি অডিও ক্যাসেটের সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন কিন্তু এলবামটি প্রকাশ পায় ১৯৯২ সালের দিকে। তাঁর আগে সারগাম থেকে প্রকাশিত শেখ ইশতিয়াকের ”নীলাঞ্জনা” এলবামের সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে শ্রোতাদের মন জয় করে নেন। সেই এ্যালবামের ”নীলাঞ্জনা”, ”নন্দিতা”, ”আমার মনের ফুলদানীতে”, ”ভাগ্যর ডাক্তার” গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এরপর সারগাম থেকে প্রকাশিত শুভ্র দেবের একক অ্যালবাম ”কোন এক সন্ধ্যায়” অ্যালবামেও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সফল হয়েছিলেন।

বর্তমান কালের সেনসশন সঙ্গীত শিল্পী ইমরানের সাথে পরিচালক মকসুদ জামিল মিন্টু, ছবি সৃজন মিউজিক বিডি
চিত্র: বর্তমান কালের সেনসশন সঙ্গীত শিল্পী ইমরানের সাথে পরিচালক মকসুদ জামিল মিন্টু, ছবি: সৃজন মিউজিক বিডি

সারগাম থেকে বেবী নাজনীনের প্রথম একক অ্যালবামের সঙ্গীত পরিচালক তিনি যে অ্যালবামেই বেবী নাজনীন তারকা খ্যাতি পায়। বেবি নাজনীনের সেই অ্যালবামের গানগুলো শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরে বিশেষ করে ”এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল” গানটি ছিলো সুপারহিট অথচ মকসুদ জামিল মিন্টু থেকে যান প্রচারের বাহিরে। সেলিম চৌধুরীকে দিয়ে ”হাছন রাজার গান” অ্যালবামেও সফল ভাবে সঙ্গীত পরিচালনা করেন যে অ্যালবামটিও সফল একটি অ্যালবাম হয়। এভাবে টুকটাক কাজ করতে করতে ১৯৮৮ সালে বিটিভিতে আল মনসুরের ”যেখানে দেখিবে ছাই” নাটকের আবহ সঙ্গীতের কাজ করেন কিন্তু হুমায়ুন আহমেদের তুমুল জনপ্রিয় ”কোথাও কেউ” নাটকে আবহ সঙ্গীত পরিচালনা করে আবারও সবার নজর কাড়েন। হুমায়ুন আহমেদের সাথে সেটাই ছিলো মিন্টুর ১ম কাজ এরপর থেকে হুমায়ুন আহমেদ এর সব নাটকে তিনিই ছিলেন আবহ সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে। কারণ হুমায়ুন আহমেদ মিন্টুকে চিনতে এতটুকুও ভুল করেননি গুণী এই মিডিয়া ব্যাক্তিত্বটিকে।

১৯৯৩/৯৪ সালে মতিন রহমানের ”আগুন জ্বলে” সিনেমায় সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ কোন চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এরপর আর কোন সিনেমায় কাজ না করলেও বিটিভিতে হুমায়ুন আহমেদের নাটক ও হানিফ সংকেতের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ তে নিয়মিত কাজ করেন।

কথা প্রসঙ্গে একদিন হুমায়ুন আহমেদ মকসুদ জামিল মিন্টুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ”মিন্টু, তুমি কি কি পুরস্কার পেয়েছো গানের জন্য?” জবাবে মিন্টু বললেন; তিনি কখনও কোন পুরস্কার পাননি, জাতীয় পুরস্কারও নয় যা শুনে হুমায়ুন আহমেদ খুবই বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন ”বলো কি! তোমার মতো ব্যক্তি কোন পুরস্কার পায়নি এটা তো সঙ্গীত অঙ্গনের ব্যর্থতা, আমাদের ব্যর্থতা!”

সঙ্গীত পরিচালক মকসুদ জামিল মিন্টু, ছবি বিবিসি বাংলা
চিত্র: সঙ্গীত পরিচালক মকসুদ জামিল মিন্টু, ছবি: বিবিসি বাংলা

১৯৯৯ সালে হুমায়ুন আহমেদ দীর্ঘ বিরতির পর যখন আবার চলচ্চিত্র পরিচালনায় এলেন তখন ”শ্রাবণ মেঘের দিন” সিনেমার সবগুলো গান ও সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব দেন মকসুদ জামিল মিন্টুকে আর এই ”শ্রাবণ মেঘের দিন” সিনেমার জন্যই মকসুদ জামিল মিন্টু সর্বপ্রথম জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। এরপর হুমায়ুন আহমেদের ”দুই দুয়ারী”, ”চন্দ্রকথা”, ”শ্যামল ছায়া”, ”আমার আছে জল”, ”ঘেটুপুত্র কমলা” সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করেন।

দারুণ মেলোডিয়াস সুরের সুরকার মকসুদ জামিল মিন্টুর সুর করা হুমায়ুন আহমেদের নাটকের একাধিক জনপ্রিয় গান আছে যার মধ্য – প্যাকেজ সংবাদ নাটকের ”মারো চিকা মারো, চিকা মারো রে”, সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড নাটকে ”যাই যাই যাই সমুদ্র দেখতে যাই”, হবলঙ্গের বাজার নাটকে ”হবলঙ্গের বাজারে গিয়া দশ টাকা জমা দিয়া”, তাঁরা তিনজন নাটকে ”মানুষ ধরো মানুষ ভজো শুন বলিরে পাগল মন” গানগুলো অন্যতম।

লেখক: ফজলে এলাহী, সিনেমা ও সংগীত বিশ্লেষক।

Share This Article
Leave a comment