আহমাদুল কবির: বিশেষ প্রতিনিধি
শনিবার দুপুরে রাজধানীর সোনারগাঁ হোটেলে সেন্টার ফর এনআরবি আয়োজিত ব্রান্ডিং বাংলাদেশ ওয়াল্ড কনফারেন্স সিরিজ-২০২২ এর উদ্বোধন ও রেমিটেন্স পদক প্রদান করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন এবং অতিথি হিসাবে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফি উদ্দিন আহমেদ গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। সেন্টার ফর এনআরবি’র চেয়ারপারসন এম এস সেকিল চৌধুরী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।
অতিথি হিসাবে মূল্যবান বক্তব্য রাখেন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, বৃটেনের ক্রয়ডন কাউন্সিলের মেয়র শেরওয়ান চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শহীদুল আলম এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের জিএম কাজী রফিকুল হাসান।
অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদের বাণী পাঠ করেন শোনান আয়েশা সিদ্দিকা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণী পাঠ করেন মাসুমা চৌধুরী। কোরআন তেলাওয়াত করেন হাফেজ ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে দেশি বিদেশি গুণিজন এবং প্রবাসী কমিউনিটি নেতৃবৃন্ধ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিত্বদের তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য পদক দেয়া হয়।
অনুষ্ঠান বক্তব্য দেয়া ছাড়াও অনুষ্ঠানস্থলে সাংবাদিকদের কিছু প্রশ্নের জবাব দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. মোমেন। তিনি সেন্টার ফর এনআরবি’র মতো অন্যদেরকেও ইতিবাচকভাবে বিদেশে বাংলাদেশকে তুলে ধরার আহ্বান জানান। তিনি সেন্টার ফর এনআরবির কার্যক্রমের ভুয়সী প্রশংসা করেন। বাংলাদেশে এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স বলে নেই দাবি করে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, দেশে আইনের শাসন তথা প্রত্যেকটি অপরাধের বিচার আইনের মাধ্যমে হোক, এটা নিশ্চিত করতে চায় সরকার। আমেরিকায় প্রতি বছর হাজার খানেক লোকের বিনা বিচারে মৃত্যু হয় জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমরা চাই আমাদের দেশে একটি লোকও বিনা বিচারে না মরুক। আমাদের দেশে এখনো অন্য দেশের তুলনায় অপরাধ কম হয় বলে দাবি করেন তিনি। বাংলাদেশ পলিটিক্যালি এবং স্ট্রাটিজিক্যালি খুব ভালো অবস্থানে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বের আকর্ষষ বাড়ছে বলেও মনে করেন তিনি। শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশ চীনের ডেথ ট্র্যাপে পড়ে যাওয়া আশঙ্কা নাকচ করে মন্ত্রী বলেন, দেশ হিসাবে চীনা ঋণ ৫ শতাংশের কাছাকাছি এতে আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সরকার বুঝে শুনে ঋণ নিচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, চরম পরিস্থিতিতেও সেনা সদস্যরা মানবাধিকার লংঘন করেন না। তিনি বলেন, সেনাপ্রধান বলেন, “অতীতের সমস্ত রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখুন, আপনারা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মানবাধিকার লংঘনের একটি ঘটনাও পাবেন না। এ কারণে আমরা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে নিয়ে গর্ববোধ করি” এভাবেই বাংলাদেশ এবং সেনাবাহিনীর ব্র্যান্ডিং হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষায় অংশগ্রহণকারী দেশ হিসেবে প্রথম সারিতে আছে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ শীর্ষে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের এই অর্জন এমনি এমনি আসেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিপুল আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা তা অর্জন করেছি। বাংলাদেশের সৈন্যদের অত্যন্ত সুশৃঙ্খল এবং মানবিক উল্লেখ করে সেনা প্রধান বলেন, নানা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। শান্তি রক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আজকে বাংলাদেশকে চেনে। তাছাড়া বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নের এক রোল মডেল। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রসঙ্গ টেনে সেনাপ্রধান বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসীরা তাদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশের ব্র্যান্ডিং করছেন। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের বৃহৎ আয়। তাদের অবদান আমাদের দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধি করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রবাসীদের এই অবদানকে সম্মান জানায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বাংলাদেশ এখন ‘দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাওয়া এক অর্থনীতির দেশ’ বলে উল্লেখ করে জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন বলেন, “অনেক সূচকেই আমরা উন্নত দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে আছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় মিয়ানমার থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ মানবতার উদাহরণ তৈরি করেছে। বাংলাদেশের অনেক অর্জন আছে যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি।”
সেন্টার ফর এনআরবি চেয়ারপারসন এম এস সেকিল চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ একটি মানবিক বাংলাদেশ। মহামারীর মধ্যে ও এত সংখ্যক মানুষের বোঝা বইতে হচ্ছে। বিশ্বের সকল কেই এই সংকট সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। শান্তি রক্ষীরা বিদেশের মাটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখছে। তাদের উৎসর্গের কথা সেভাবে প্রচার হয়নি। এগুলো তুলে ধরতে হবে। শুধু এসব নয়, এ দেশকে তুলে ধরবার বহুবিষয় রয়েছে। আমরা সেটা করছি না। শুধু শান্তি রক্ষা নয়, সেখানে ব্যবসা বাণিজ্যে র যথেষ্ট সুযোগ আছে। সেদিকে গিয়ে দেশের মর্যাদা পেশাদারিত্বের সাথে এগিয়ে যেতে হবে। ২২ বিলিয়ন ইউএস ডলার এসেছে, প্রবাসীদের কাছ থেকে। মিশনগুলোতে কূটনীতিক উদ্যেগ তেমন নেই। যে যে দেশের সাথে থাকবে, ভাষা সংস্কৃতির সাথে মিশে যাবার মত মানুষদের পাঠাতে হবে।
এছাড়া উপস্থিত অতিথি বিএমইটি’র, মহাপরিচালক, শহিদুল আলম বলেন, প্রতিমাসে ১ লাখের বেশি শ্রমিক বাইরে যাবার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সবাইকে ভ্যাকসিনেশনের সুযোগ অব্যহত আছে। জাতি হিসেবে বিশ্বে তুলে ধরতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনবদ্য অবদান রাখার সুযোগ আছে। এনআরবিদের দেশের মধ্যে মর্যাদা বাড়াতে হবে। শ্রমিকদের পাসপোর্টের আলাদা রঙ ও ক্লাসিফিকেশন বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, প্রবাসী সকলের পারস্পরিক যোগাযোগ আরো বাড়াতে হবে। মহামারীর পুরোটা সময় দেশের পক্ষে নিরলস পরিশ্রম করে গেছে। দেশের বাইরে প্রত্যেক বাঙালি ই বাংলাদেশের প্রতিনিধত্ব করে। দেশের প্রতি এই মমত্ববোধ যত বাড়বে, বিশ্বে এই জাতি তত মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে। পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের করোনা ব্যবস্থাপনা অনেক ভালো। এটা কোন আত্মতৃপ্তির কোন বিষয় না। প্রতিকার ও প্রতিরোধ করে, সংক্রমন নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে।
মানব সম্পদ রফতানি সম্পর্কে লন্ডন কোরর্ডনের মেয়র, শেরওয়ান চৌধুরী বলেন, মানব সম্পদ রফতানিতে বাংলাদশে র সুনাম আছে। দেশের অর্থনীতর জন্য প্রবাসীরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, তাদের সংকটের অন্ত নেই।
সেনাবাহিনী প্রধান, এম এস এফ শফিউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রবাসীরা এজন্যই কঠোর পরিশ্রম করে। দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নে তাদের অবদানকে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। এ দেশ এখন অনেক দেশের কাছে, অনুকরণীয় মডেল। অনেক অর্জনের মধ্যে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ অন্যতম। বেশি সংখ্যায় অংশ নেয়ায় বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অবস্থায় আছে। সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি সদস্য সেখানে কাজ করছে। অনেক ঝুঁকি সেনাবাহিনী নেয়, এটা শুধু দেশের প্রয়োজনই। প্রত্যেকটি দ্বায়িত্ব পালনে ধীরে ধীরে দক্ষতার উন্নয়ন করেছে এই সদস্য রা। এজন্যই আমরা গর্ব করতেই পারি। বাংলাদেশ কে আমাদের সবাইকে ব্রান্ডিং করে এগিয়ে নিতে হবে। ইউএন মিশন ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ সেনবাহিনীর অবদান আছে।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী, শামসুল আলম বলেন, স্বাধীনতার পরে নেতিবাচক ব্রান্ডিং হলেও এখন সে অবস্থায় নেই। সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় একটি শক্ত ভিত্তি র উপর দাড়িয়ে যাচ্ছে এই দেশ। এই সরকার ক্ষমতা য় এসে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ এর ব্যবস্থাপত্র পরিহার করে নিজস্ব বুদ্ধি তে চলার শুরু করল। দুই দুই টা মাইল ফলক স্পর্শ করতে পারার অগ্রগতি বদলে দিয়েছে এই দেশের ভাবমূর্তি। বাস্তবায়নযোগ্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ। নেতিবাচক ব্রান্ডিং দুভাগ্যজনক। দেশ প্রেমিকরা এটা কিছুতেই করতে পারে না। তাদের সময়োচিত জবাব দিতে, ব্রান্ডিং বাংলাদেশ কে জোরদার করে এগিয়ে নিতে হবে। বিদেশে শুধু বিনিয়োগ নয়, আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করবে বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, মশিউর রহমান বলেন, মহামারী র পর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশের শ্রমিকদের চাহিদা বাড়ছে। এদের আরো দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। উন্নতদেশেও পেশাজীবীদের যুক্ত হবার লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে। প্রবাসীদের জব সিকিউরিটি ও ইনকাম সিকিউরিটি বাড়ানোর কথা ভাববার অবকাশ আছে। দেশে ফিরে আসলে যাতে এদের কাজে লাগানো যায় সেদিন ভাবনা চিন্তা র অবকাশ আছে। এনআরবি দের পৃথক কোন পরিচয় পত্র যায় কি না সে বিষয় টি ভেবে দেখতে হবে। শ্রমিকদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থাকতে হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসি আরো বাড়াতে হবে। সফলতার গল্পগুলো বিশ্বের সকল প্রান্তের মানুষের কাছে পৌছে দিতে হবে। রিয়েল টাইম মার্কেট অপারচুনিটিজ গ্রহন করতে হবে। ব্রান্ডিং ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার এখনই সময়। বহুপক্ষীয় উদ্যেগ গ্রহন করা হচ্ছে। শান্তিরক্ষা মিশন ইতিবাচক বাংলাদেশের বড় উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ব্রান্ডিং অর্থনৈতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে এগুনোর কোন বিকল্প নেই। এখন অনেক অনেক বড় পরিমাণে বিনিয়োগের সুযোগ অবারিত আছে। তথ্য প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, কৃষি সহ আরে বেশ কিছু খাতে বিনিযোগ করার সুযোগ আছে। সবাইকে এক সাথে কাজ করার সুযোগ তৈরির কোন বিকল্প নেই। বিনিয়োগকারীদের সরকার সব ধরনের সহযোগিতা ও পরিবেশ দিচ্ছে। টেকসই অবকাঠামো সহ পরিবেশ পুরোপুরি প্রস্তুত। এখন, শুধু প্রয়োজন বিনিয়োগ নিয়ে আসা এবং এর সুফল ঘরে তোলা। জাতির ব্রান্ড ইকুইটি বাড়াতে হবে। যথাসম্ভব একে কাজে লাগানোর বিষয়ে ভাবতে হবে।
বাংলাদেশের ব্রান্ড নাম হলো, ল্যান্ড অব অপারচুনিটি। বহু রকমের যে সব অপপ্রচার আছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে। সম্ভাবনা তুলে ধরতে হবে।