আহমাদুল কবির, বিশেষ প্রতিনিধি:
প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সমীকরণে প্রতিনিয়ত যুদ্ধে টিকে থাকতে হচ্ছে প্রবাসীদের। পরিবারের সুখের আশায় বিদেশে পড়ে থাকতে হয় তাদের। দেশে থাকা পরিবার পরিজনদের আকাশচুম্বী চাওয়া-পাওয়ার অনেকটাই নির্ভর করে তাদের উপার্জনের ওপর। হাসিমুখে তাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে যাচ্ছে দেশকে। কেউ কেউ পরিবারের মুখে হাসি ও স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনলেও অনেকেই প্রবাসে অসহায়ত্বের গ্লানি টানছেন। পদে পদে তারা ফাঁদ পেতে থাকা প্রতারকদের দ্বারা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। অথচ দেশ গড়ার পিছনে এ সারথিদের রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। উর্দ্ধগতিতে নিয়ে এসেছেন দেশের রিজার্ভ ফান্ড।
বিদেশে ভিসা না থাকলে, ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি না করা হয় বা ভিসার অপব্যবহার হলে বিদেশে গ্রেফতার হয়, শাস্তি হয় এবং নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়, সে দেশের আইন, রীতি নীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে কটাক্ষ করলে বা সামাজিক উৎপাত সৃষ্টি করলে বা মানুষের অসন্তোষের কারন হলেও তাকে সে দেশে অবস্থান করতে দেওয়া হয় না। এমন কি সে দেশের স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িত হলে বা সরকারের কোন নীতির সমালোচনা করলে বা মিছিল মিটিং ইত্যাদিতে অংশ নিলেও সে দেশে অবস্থান করা যায় না। গোপনে অবৈধ ব্যবসা, পণ্য পাচার, মানব পাচার বা পতিতা বৃত্তিতে বাধ্য করা হলে সেটাও আইন বিরোধী এবং সে দেশে থাকার সুযোগ নাই, অর্থাৎ অপরাধ কাজে জড়িত হলে আইনের আওতায় আসতেই হবে। অনেকে অজান্তে বা জেনে বুঝেই অনেক অপরাধের সাথে জড়িয়ে যায় যেমন চুরি, ছিনতাই, অপহরণ , ডাকাতি, মাস্তানি, মেয়েদের উত্যক্ত করা ইত্যাদি কাজে জড়িয়ে সে দেশে অবস্থান করার সুযোগ নষ্ট করে এবং দেশের ইমেজ নষ্ট করে। কোন দেশে প্রবেশ করার বিশেষ শর্ত থাকে, সে শর্ত মেনেই ভিসার জন্য আবেদন করা হয় এবং সে অনুযায়ী ভিসা ইস্যু করে। এই ভিসার শর্ত ভঙ্গ হলেই সে দেশে অবস্থান করার সুযোগ নেই এবং আইনের আওতায় চলে আসে।
বৈধ ও অবৈধভাবে অন্তত ৮ থেকে সাড়ে ৮ লাখের মতো বাংলাদেশি রয়েছেন মালয়েশিয়ায়। দেশটির ১৩টি প্রদেশের পামওয়েল আর রাবার প্ল্যান্ট, মেটাল, মেনুফ্যাকচারিং,কন্সট্রাকশন, হাই স্কিলড স্পেসিফিক ওয়ার্ক, তেল-গ্যাস ও রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিতে সবজায়গাতেই বাংলাদেশিরা দক্ষতার সাথে কাজ করছেন, কুড়াচ্ছেন সম্মানও। স্বাধীনতার পর থেকে বন্ধু প্রতীমদেশ মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। এ সম্পর্কের ধারা বজায় রেখে শ্রম রপ্তানী,ব্যবসা বাণিজ্য পর্যটনে ও দু,দেশ এগিয়ে যাচ্ছে দুরন্তগতিতে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় করোনা ভাইরাস বিস্তার রোধে বেধে দেওয়া সরকারের বিধি নিষেধ ভঙ্গ করে অধিক সংখ্যক লোক জমায়েত হয়ে ঈদের নামাজ আদায় করাকে মালয়েশিয়ার নাগরিকরা ভালোভাবে নেয়নি, তাদের ধারনা মালয়েশিয়াকে তোয়াক্কা করেনি বিদেশি নাগরিক এবং এটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে, ফলে একটি প্রাদেশিক পুলিশ প্রধান জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। পুলিশ কঠোর অবস্থানে গিয়ে গ্রেফতার করেছে। এর পূর্বে করোনাকালে বিধি নিষেধের মধ্যেও পুলিশের সহানুভূতি দেখিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই একটি ঘটনা যেন পাল্টে দিল সবকিছুকে।
একইভাবে ঈদের রাতে নিয়ম ভেঙ্গে বাসস্থানে জমায়েত হয়ে আনন্দ করে প্রবাসীরা, শঙ্কিত প্রতিবেশী পুলিশে খবর দিলে পুলিশ এসে গ্রেফতার করে। শুধু বর্তমান পরিস্থিতিতে নিয়ম কানুন তোয়াক্কা না করার ফলে আইনের আওতায় যেতে হয়েছে। এতে মালয়েশিয়া সরকার বলেছে যারা এসওপি মানেনি তাদের শাস্তি দিবে এবং নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিবে। সময়ের প্রেক্ষিতে এই কঠোর বিষয়গুলো বিবেচনা না করার কুফল ভোগ করতে হচ্ছে মালেশিয়াস্থ বাংলাদেশীদের।
এই ধরনের নানান কর্মকান্ড বিদেশে থাকা অন্যান্য পেশার নাগরিকদের জীবন কঠিন করে তোলে, কেননা বিদেশে যে কোন ব্যাক্তির ক্ষেত্রে আগে দেশ দেখা হয়। ভালো বা মন্দ কাজের জন্য মুহূর্তে সে দেশ সম্পর্কে ধারনা তৈরি হয় এবং সেই ভাবে নাগরিকদের সাথে আচরণ করে। তাই বিদেশে নাগরিকের যে কোন কাজ দেশের ইমেজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিদেশে আয় করে দেশে বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে যেমন বলা হয় দেশের জন্য করছি, ঠিক তেমনি বিদেশের মাটিতে করা অনিয়ম বা খারাপ কাজের প্রতিক্রিয়াও নিজ দেশের উপরই বর্তায় অর্থাৎ দেশের ক্ষতি হয়। একজন প্রবাসি সুনাম ও দুর্নাম দুটোই দেশের জন্য বয়ে আনে। মানুষ ভালোটা কমই মনে রাখে। তাই বিদেশে ব্যাক্তিকে সাবধান হতে হবে, আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে যেমন যা ইচ্ছা করা যায় না, বিদেশ ঠিক তেমনই, যা ইচ্ছা তাই করা যায় না। যে দেশে বসে আয় করে নিজের পরিবারের উন্নতি করা হয়, সে দেশ ও কর্মক্ষেত্রের প্রতি দায় দায়িত্ব পালন করতে হয়, নইলে প্রত্যাখ্যান হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক থাকে।
একদিকে ভুলে বা ইচ্ছায় আইন কানুন বিধি ভঙ্গ করে প্রবাসী বিপদে নিপতিত হয় অপর দিকে এসব নিয়ে প্রবাসীদের অধিকার ইত্যাদি কথা বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবাসীদের উস্কে দেওয়ার কথা পুলিশ বলে থাকে। এতে সে দেশ আরো কঠোর অবস্থানে যায়। ইমিগ্রেশন আইন বলে বিদেশিদের অধিকার হল ভিসা, এই ভিসার শর্ত মেনে চললেই অধিকার সুরক্ষিত থাকে। বিদেশি ব্যাক্তি সুরক্ষিত থাকবেন কি না নিজেকে ঠিক করতে হবে। ফলে সে দেশ সম্পর্কে ধারনা নিয়েই বিদেশে যাওয়া হয়। পরিবারের লোকজনও নিয়ম কানুন মেনে চলতে অনুরোধ করে যেন একলা জীবনে কোন বিপদ না আসে। এটাও ভাবতে হবে যে পুরো পরিবার তাকিয়ে আছে এক প্রবাসীর দিকে। এ বিষয়ে নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশী সেন্টারের প্রেসিডেন্ট এস এম শেকিল চৌধূরী বলেন,
‘প্রবাসে যেই হোক না কেন শর্ত মেনে না চললে সে দেশ সহ্য করে না, তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসে, শাস্তি দেয় এবং বহিষ্কার করে। ফলে বিদেশে অবস্থান করে আয় রোজগার করা যায় না, খালি হাতে ফিরতে হয়। মুহুর্তের মধ্যে সব কিছু ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন কি যে দেশ বিদেশিদের আশ্রয় দেয় সেখানেও নিয়মের বাইরে যা ইচ্ছা করার সুযোগ নেই।’
অভিবাসন বিষয়ক সাংবাদিক মরিাজ হোসেন গাজী বলেন,
‘বাংলাদেশ থেকে সব থেকে বেশি বিদেশে যায় অভিবাসী কর্মী, তারা নিয়োগ চুক্তি সম্পাদনের পর, সে দেশ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারনা নিয়েই যায়। এমসময় সে দেশের নিয়ম কানুন জেনে নেয়, বুঝে এবং শিখে ফেলে। এমন কি সে দেশের ভাষা শিখে ফেলে। এসবই সেই দেশের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় প্রকাশ এবং দীর্ঘদিন অবস্থান করে আয় করার উপায়। এ কারণে অধিকাংশ প্রবাসীর সুনাম আছে। সামান্য অংশ নানান ধরনের প্রলোভনে বা নিজ ইচ্ছায় এমন কিছু করে যার ফলে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না, নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যত নষ্ট করে। এসবের প্রতিক্রিয়া হলো পরে সে দেশে লোক পাঠানো কঠিন হয়ে যায় এবং যারা সে দেশে অবস্থান করে তাদের জন্যও অনেক কঠিন হয়। পরিবারেও খারাপ অবস্থা হয়। তাই এসব বুঝে বিদেশে অবস্থান করতে হবে, যে সুযোগ পেয়েছে সেটার সঠিক ব্যবহার করতে হবে। সমস্যা হলে নিয়োগকর্তা এবং সে দেশে অবস্থিত দূতাবাসকে জানাতে হবে।’